Logo

স্বপ্নের নগর আজ দুঃস্বপ্নের শহর!

profile picture
বিশেষ প্রতিবেদক
৩০ অক্টোবর, ২০২৫, ১৭:৫৫
13Shares
স্বপ্নের নগর আজ দুঃস্বপ্নের শহর!
ছবি এআই ।

ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল মহানগরী, আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ২০২৫ সালে এসে এর জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটির কাছাকছি, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি। দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফলে ঢাকা একদিকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে, অন্যদিকে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এই দুর্ভোগের মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং জনসংখ্যার অত্যধিক চাপ। ফুটপাথ দখল, মোটরসাইকেলের অনিয়মিত চলাচল, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, রাস্তা খোঁড়াখুড়ি, ভাঙা সড়ক, মশার উপদ্রব, ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট, গণপরিবহনের নৈরাজ্য, যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং জলাবদ্ধতা এসব সমস্যা ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে।

ঢাকার এই সমস্যাগুলো নতুন নয়, কিন্তু ২০২৫ সালে এগুলো আরও তীব্র হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুসারে, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর হাজারো মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শহরের পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে, যা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো এসব সমস্যার গভীরতা তুলে ধরা এবং সচেতনতা বাড়ানো।

বিজ্ঞাপন

ফুটপাথ দখল এবং মোটরসাইকেল উঠে যাওয়া

ঢাকার ফুটপাথগুলো পথচারীদের জন্য নির্ধারিত হলেও, বাস্তবে এগুলো দখল হয়ে গেছে বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপে। হকার, দোকানপাট, নির্মাণ সামগ্রী এবং যানবাহনের পার্কিংয়ের কারণে ফুটপাথ প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মতিঝিল, গুলশান, ধানমন্ডি এলাকায় ফুটপাথের অধিকাংশ অংশ দখল করে রাখা হয়েছে, যার ফলে পথচারীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ঢাকার ফুটপাথ দখলের সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যা চলাচলকে অসম্ভব করে তুলেছে।

মোটরসাইকেল ফুটপাথে উঠে যাওয়া আরেকটি গুরুতর সমস্যা। যানজট এড়াতে মোটরসাইকেল চালকরা প্রায়ই ফুটপাথ ব্যবহার করেন, যা পথচারীদের জন্য বিপজ্জনক। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ যাওয়া শিক্ষার্থী এবং বয়স্কদের জন্য এটি একটি নিত্যদিনের যন্ত্রণা। পুলিশের অভিযান সত্ত্বেও এই প্রবণতা কমছে না, কারণ আইন প্রয়োগের দুর্বলতা। এতে প্রতিদিন শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে, যার মধ্যে অনেকগুলো মারাত্মক। এই সমস্যা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং জনজীবনকে আরও কষ্টকর করে তুলছে।

বিজ্ঞাপন

যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা

ঢাকায় আবর্জনা ব্যবস্থাপনা একটি চরম অসঙ্গতি। প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ টন আবর্জনা উৎপন্ন হয়, কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের সংগ্রহ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। যত্রতত্র ময়লা ফেলার ফলে রাস্তা-ঘাট, খাল-বিল এবং নদী দূষিত হচ্ছে। মতিঝিল এবং ওয়ারী এলাকায় আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়, যা গন্ধ এবং রোগের উৎস। এই সমস্যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে, বিশেষ করে ডেঙ্গু এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের। আবর্জনার অপর্যাপ্ত সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহারের অভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ল্যান্ডফিল সাইটগুলো যেমন আমিনবাজারে অতিরিক্ত ভরাট হয়ে গেছে, যা মাটি এবং পানি দূষণের কারণ। এতে শহরের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনমান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ

ঢাকার অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ শহরের সৌন্দর্য এবং নিরাপত্তাকে ধ্বংস করছে। রাজউকের নিয়ম লঙ্ঘন করে ভবনগুলো নির্মিত হচ্ছে, যার ফলে খোলা জায়গা কমছে এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, পুরান ঢাকায় অনেক ভবন অবৈধভাবে নির্মিত, যা আগুন এবং ধসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এই নির্মাণের ফলে আলো-বাতাসের অভাব এবং ভিড় বাড়ছে, যা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। শহরের সবুজ এলাকা কমে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি এবং ভাঙা সড়ক

বিজ্ঞাপন

ঢাকার রাস্তাগুলো প্রায়ই খোঁড়াখুড়ি করা হয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে, কিন্তু সময়মতো মেরামত না হওয়ায় ভাঙা সড়কের সমস্যা তীব্র। উদাহরণস্বরূপ, মিরপুর এবং উত্তরায় প্রায়ই গ্যাস, পানি বা বিদ্যুতের লাইনের জন্য রাস্তা খোঁড়া হয়, যা যানজট বাড়ায়। ভাঙা সড়কের কারণে দুর্ঘটনা এবং যানবাহনের ক্ষতি হচ্ছে। এই সমস্যা শহরের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে, কারণ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে।

মশার যন্ত্রণা

মশার উপদ্রব ঢাকার একটি চিরকালীন সমস্যা, যা জলাবদ্ধতা এবং আবর্জনার কারণে আরও বেড়েছে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিবছর হাজারো মানুষকে আক্রান্ত করে। ২০২৫ সালে ডেঙ্গুর কেস রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, যার মূলে রয়েছে অপর্যাপ্ত ফগিং এবং সচেতনতার অভাব। এই যন্ত্রণা বিশেষ করে দরিদ্র এলাকায় তীব্র, যেখানে চিকিৎসার সুবিধা কম।

বিজ্ঞাপন

ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট

ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার পরিবহনের একটি অংশ হলেও, এদের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ট্রাফিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। এগুলো ফুটপাথ এবং মূল রাস্তায় অবাধে চলে, যা দুর্ঘটনা বাড়ায়। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই রিকশাগুলো ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনা বাড়িয়েছে। এদের ব্যাটারি চার্জিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিবেশ দূষণও হচ্ছে।

গণপরিবহনে নৈরাজ্য

বিজ্ঞাপন

ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল। বাসগুলো অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে, চালকরা নিয়ম লঙ্ঘন করে এবং টিকিটের অসঙ্গতি রয়েছে। এতে মহিলা এবং শিশুরা বিশেষ করে কষ্ট পান। একটি পোস্টে বলা হয়েছে যে, গণপরিবহনের নৈরাজ্যের কারণে বিকল্প যানবাহন বাড়ছে।

যানজট

ঢাকার যানজট বিশ্ববিখ্যাত, যা প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা সময় নষ্ট করে। অপর্যাপ্ত রাস্তা এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এটি তীব্র। একটি গবেষণা প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, এটি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে।

বিজ্ঞাপন

বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ

ঢাকার বায়ু দূষণ বিশ্বের সর্বোচ্চ, যার মূলে রয়েছে যানবাহন, শিল্প এবং আবর্জনা পোড়ানো। অছও প্রায়ই ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শব্দদূষণ হর্ন এবং নির্মাণের কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে যে, এটি নীরব ঘাতক।

জলাবদ্ধতা

বিজ্ঞাপন

মৌসুমী বৃষ্টিতে ঢাকা জলমগ্ন হয়ে যায়, কারণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত এবং খাল দখল। এতে যানজট এবং রোগ বাড়ে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এটি অবাসযোগ্য করে তুলেছে।

আধুনিক ঢাকার এই দুর্ভোগগুলো অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফল। এগুলোর সমাধানে সরকার, নাগরিক এবং সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। পরিকল্পিত নগরায়ণ, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতা ছাড়া ঢাকা অবাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না ঘটলে ঢাকা আরও অচল নগরীতে পরিণত হবে। রাজধানীকে বাসযোগ্য রাখতে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী দিনে এ শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

নগরবীদ ও পরিবেশবাদী ইকবাল হাবিব বলেন, নগরজুড়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিতে ১১টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রায় ৫৪টিরও বেশি সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে কাজ করছে। পারস্পরিক বোঝাপড়া ও পরিকল্পিত কর্মধারা না থাকায়, যথাযথ সমীক্ষা ছাড়া গৃহীত বড় বড় প্রকল্পগুলো এখন নাগরিক জনস্বাস্থ্য, চলাচল ও জনপরিসেবাকে দুর্বৃত্তায়ন দৌরাত্ম্যের পথে ঠেলে দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আইনের বিধিবিধান ও নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে অনীহা বা অবজ্ঞাই এই দুরবস্থার মূল কারণ। যা জবাবদিহিতামূলক প্রয়োগ বা এনফোর্সমেন্ট ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। তাই যথার্থ প্রকল্প গ্রহণ, দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল বাস্তবায়ন, একইসঙ্গে বাস্তবায়নকালীন জনভোগান্তি নিরসন নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি নগরসেবায় জবাবদিহিতাহীনতার অবসান ঘটাতে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-অ্যাডমিন, প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ) মোঃ আনিছুর রহমান বলেন— “অটোরিকশা চলাচল নিয়ে আমাদের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট। মেইন রোডে কোনোভাবেই অটোরিকশা প্রবেশ করতে পারবে না— এ লক্ষ্যে আমাদের পুলিশ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

মোটরযান আইনের বিধান অনুযায়ী অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সুযোগ না থাকায় আমরা ডাম্পিং কার্যক্রম পরিচালনা করি। মেইন রোডে কোনো অটোরিকশা পাওয়া মাত্রই সেটি সঙ্গে সঙ্গে ডাম্পিং করা হয়।

আগামী ২ নভেম্বর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হবে— যেখানে মেইন রোডে অটোরিকশা চলাচলে থাকবে ‘জিরো টলারেন্স’।

এছাড়া, যাত্রীবাহী বাসগুলো নির্ধারিত বাসবে ছাড়া যাত্রী উঠানামা করলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সড়কে কোনোভাবেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। এই কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নে নাগরিকদের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— আমরা সেই সহযোগিতাই প্রত্যাশা করছি।”

জেবি/এসডি
Logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ( শফিক )

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৫৭, ময়মনসিংহ লেন, ২০ লিংক রোড, বাংলামটর, ঢাকা-১০০০।

ফোনঃ 02-44615293

ই-মেইলঃ dailyjanobaninews@gmail.com; dailyjanobaniad@gmail.com

জনবাণী এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত। কপিরাইট © ২০২৫

Developed by: AB Infotech LTD